Ticker

100/recent/ticker-posts

Translate

ধর্মমঙ্গল কাব্যকে "রাঢ়ের জাতীয় কাব্য'' বলার কারণ উল্লেখ করো এই ধারায় যেকোনো একজন কোভিদ প্রতিভার মূল্যায়ন করো

 ১) মহাভারতের অনুবাদের ধারায় কবি কাশীরাম দাসের কবিকৃতি সংক্ষেপে মূল্যায়ন করো।

উত্তর:- মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস । তিনি সপ্তদশ শতাব্দীতে কাব্য রচনা করেন । মহাভারতের অনুবাদের ধারায় অনুবাদের অন্যতম কবি কাশীরাম দাস । সপ্তদশ শতকে তিনি মহাভারত অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেন । তাঁর কাব্য নাম ‘ ভারত পাঁচালি ' । কাশীরাম বর্ধমানের ইন্দ্রানী পরগনার অন্তর্গত সিঙ্গিগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । গুরু অভিরাম মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে তিনি কাব্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেন । আনুমানিক ১৬০২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি কাব্যরচনা করেন । আত্মপরিচয় শীর্ষক অংশে তিনি জানিয়েছেন—

      “ ইন্দ্রানী নামেতে দেশ পূর্বাপরস্থিতি । 

    দ্বাদশ তীর্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথী ।।

     কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিঙ্গিগ্রাম । 

       প্রিয়ঙ্কর দাসপুত্র সুধাকর নাম ।। ”

 কাশীরাম বাঙালি জীবনের কথা মাথায় রেখেই কাব্যরচনা করেছিলেন । তবে তিনি অষ্টাদশ পর্বের মহাভারতের সমগ্র অনুবাদ করতে পারেননি , মাত্র চারটি পর্ব অনুবাদ করেন— “ আদি সভা বন ও বিরাটের কতদূর / ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর । ” কাশীরাম সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন , ফলে তাঁর কাব্যে সে জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায় । তেমনি পয়ার ত্রিপদী ছন্দে তিনি সহজ সরল ভাষায় বাঙালি জীবনের পারিবারিক ও সামাজিক আদর্শকে সামনে রেখে কাব্য গড়ে তুলেছিলেন । তেমনি রয়েছে । ভক্তিভাবের পরিচয় । অর্জুনের অনুপম সৌন্দর্যকে তিনি ভাষার মায়াজালে ও অনুপ্রাসের শব্দছটায় সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন । বাঙালির চরিত্র বৈশিষ্ট্য , ধ্যানধারণা সমস্তকে সামনে রেখে তিনি কাব্য পরিক্রমায় অবতীর্ণ হন । ফলে তাঁর কাব্যের অর্জুন ও ভীম ক্ষত্র তেজে দীপ্ত নয় , বাঙালি জীবনের মতো সহজ সাধারণ । তেমনি সভাপর্বে দ্রৌপদী ও হিড়িম্বার কলহ বাঙালি জীবনের চিরন্তন সতীন কলহকেই মনে করিয়ে দেয় । তাঁদের হাস্য পরিহাস , ব্যঙ্গ - বিদ্রূপের রঙছটা বাঙালি জীবনের চিরন্তন ঐতিহ্যকেই মনে করিয়ে দেয় । শিল্পরীতিতে কাশীরাম ক্লাসিক আদর্শকে সামনে রেখেই কাব্য পরিক্রমা করেছেন । কৃষ্ণের বিশ্বরূপ বর্ণনায় তিনি সংস্কৃতবহুল শব্দ প্রয়োগ করে এক ক্লাসিক আদর্শের সমন্বয় ঘটিয়েছেন , যা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর -- 

        “ সহস্ৰ মস্তক শোভে সহস্ৰ নয়ন ।

         সহস্র মুকুটমণি কিরীট ভূষণ ।। 

         সহস্র শ্রবণে শোভে সহস্ৰ কুণ্ডল ।

          সহস্র নয়নে রবি সহস্ৰ মণ্ডল ।। ”

 লোকগল্পে বলা হয় ‘ যা নেই ভারতে , তা নেই ভারতে । ' ফলে কাব্যরীতি ও বাক্যরীতিতেও তিনি ক্লাসিক আদর্শ বজয় রেখেছেন । আসলে কাশীরামকে এক মহাভারতীয় ব্যাপ্তি রচনা করতে হয়েছিল । তৎসম শব্দ ও অলংকারের ঝংকারে তিনি যে শব্দবন্ধন গড়ে তুলেছেন তা সত্যি প্রশংসনীয় — অনুপম তনুশ্যাম নীলোৎপল আভা ’ , ‘ মহাবীর্য যেন সূর্য জলদে আবৃত ’ , ‘ শ্রীবৎস কৌস্তভ মণি শোভিত হৃদয় ’ ইত্যাদি । ঐতিহ্যকে সামনে রেখে তিনি কাব্য গড়ে তুললেও ব্যাসদেবকে হুবহু অনুসরণ করেননি । মূলের অনেক হেরফের যেমন ঘটিয়েছেন তেমনি নতুন কাহিনিও সংযোজন করেছেন । মহাভারতকে তুলনা করা হয় মহাসমুদ্রের সঙ্গে । ডুবুরি যেমন সমুদ্র খুঁজে মণিমুক্তা তুলে নিয়ে আসেন কাশীরামও তেমনি বিপুল মহাভারতের জলসিন করে মণিমুক্তা আহরণ করেছেন । বাঙালির বীরত্বভাব , ধর্মপরায়ণতা , লোকাচার , জীবনর ভ্রাতৃপ্রেম ও আদর্শ সবই তিনি দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন । মধ্যযুগের সমগ্র কাব্যধারায় কাশীরাম দাস এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী । বাঙালির উপযোগী করে মহাভারত রচনার জন্য তিনি চিরদিন বাঙালির কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন । এজন্যই মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন— 

   “ মহাভারতের কথা অমৃত সমান

 হে কাশী করীশ দলে তুমি পুণ্যবান ।


২)    অথবা 

ধর্মমঙ্গল কাব্যকে "রাঢ়ের জাতীয় কাব্য'' বলার কারণ উল্লেখ করো এই ধারায় যেকোনো একজন কোভিদ প্রতিভার মূল্যায়ন করো

উত্তর:- রাঢ়ের জাতীয় কাব্য বলা হয় ধর্মমঙ্গল কাব্যকে । ধর্মমঙ্গলের পটভূমি রাঢ়বঙ্গ । ধর্মঠাকুরের যে প্রতিমূর্তি তা শুধু রাঢ়বঙ্গেই প্রচলিত । অন্যান্য মঙ্গলাকাব্য বৃহত্বঙ্গে প্রচলিত হলেও ধর্মমঙ্গল ভৌগোলিক সীমার দিক থেকে রাঢ়বঙ্গেই প্রচলিত , তাই এটি রাঢ়ের জাতীয় কাব্য । 

■ ধর্মমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী ।

 ■ তিনি অষ্টাদশ শতকের কবি । 

 ■ ধর্মমঙ্গলের সর্বাধিক প্রচারিত কবি ঘনরাম চক্রবর্তী । 

ধর্মমঙ্গলের কবিদের মধ্যে তিনিই প্রথম মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করেন । কবির নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার দাদোমর নদীর তীরে কৃষ্ণপুর গ্রামে । কবির কাব্যনাম ‘ অনাদিমঙ্গল ’ । তবে কাব্যটি ‘ শ্রীধর্মসঙ্গীত ’ ও ‘ মধুর ভারতী ’ নামেও পরিচিত । ঘনরামই একমাত্র কবি যিনি কাব্যরচনায় কোনো দেবীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি । আসলে তিনি ছিলেন বিচক্ষণ পণ্ডিত ব্যক্তি । অল্পবয়সেই শিক্ষাগুরুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন ‘ কবিরত্ন ’ উপাধি । সেই প্রতিভা কাব্য রচনাতেও প্রয়োগ করেছিলেন । 

প্রচলিত ধর্মমঙ্গলের কাহিনিকেই কবি বিস্তৃত পরিসরে রূপ দান করেছেন । ঘনরামের কাব্য ‘ মধুর ভারতী ’ নামেও পরিচিত । আসলে তিনি কাব্যকে বিচিত্র ঘটনাসন্নিবেশে সাজিয়ে তুলেছেন , কিন্তু কখনোই তা রসহীন হয়ে যায়নি । পুরাণকে সামনে রেখেই তিনি কাব্যপরিক্রমায় নেমেছেন । ফলে তাঁর কাব্যে রামায়ণ , মহাভারতের প্রভাব দেখা যায় । লাউসেনের বাল্যলীলা , কৃষ্ণের বাল্যলীলা অনুসারী , ইছাই ঘোষ ও লাউসেনের সংগ্রামের কাহিনি যেন অনেকটাই রাম - রাবণের যুদ্ধকে সামনে রেখে কবি গড়ে তুলেছেন।

বাঙালি জীবনের চিরন্তন আদর্শ থেকে ঘনরামের কাব্য বঞ্চিত হয়নি । ভক্তিভাবুকতা , ধর্মপথ , আদর্শনিষ্ঠ জীবন সবই ঘনরামের কাব্যে বর্তমান । তাই লাউসেন যুদ্ধযাত্রা করলেও রঞ্জাবতী মঙ্গলকামনায় প্রার্থনা করেন । যুদ্ধবীরকে আর কিছুক্ষণ সেবা করতে চান--

 “ কালি অতি শুভদিন গৌড়ে তুমি যাবে ।

 অভাগীর রন্ধন বাপু আজি কিছু খাবে ।। ”

  চরিত্র সৃষ্টিতেও ঘনরামের মুন্সিয়ানা মেলে । কালুডোম , লখাই , লাউসেন প্রভৃতি চরিত্র নির্মাণে তিনি অনন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন । হাস্যরস , পৌরাণিকতা থাকলেও তিনি চরিত্র নির্মাণে ক্লাসিকতাকে বারবার প্রাধান্য দিয়েছেন । মহামদ লোভ দেখিয়ে হরিহরকে বন্দি করতে চাইলে হরিহরের স্ত্রী বাধা দেয় । তখন হরিহর স্ত্রীকে যা বলে তার মধ্যে রয়েছে পৌরাণিকতার সঙ্গে ক্লাসিকতা---

      “ দুঃখে গেল গতর গোঙাব কতকাল ।     পিতৃলোক ধর্ম ভয়ে বেড়ে দুঃখ জাল ।। 

তার সাক্ষী প্রভুরাম অখিলের পিতা ।

 রাজ্যনাশ বনবাস হারাইল সীতা ।। ”

 ধর্মমঙ্গল রাঢ়ের জাতীয় কাব্য । তাই চরিত্র সৃষ্টিতেও রাঢ়ের ভৌগোলিক জীবনচেতনা ও আঞ্চলিকতাকে কবি প্রাধান্য দিয়েছেন । তেমনি রয়েছে ছন্দবোধ ও শব্দের সঠিক প্রয়োগ । শব্দের দ্রুত প্রয়োগ করে যুদ্ধ বর্ণনাকে তিনি নিজেও যেন চলনশীল করে । তুলেছেন---

 “ টন টান্‌ ঠন ঠন্‌ ঢাল চলে ঢন ঢ 

ঝন্ ঝান্ হন রণ নাদ । দেখিতে বিপরীত , চৌদিকে চমকিত মামুদা ভাবে পরমাদ ।। ”

 ধর্মমঙ্গলের কাহিনিকে ঘনরামই মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে রূপ দান করেছেন । ধর্মমঙ্গল রাঢ়ের জাতীয় কাব্য হিসেবে দাবি করতে পারে ঘনরামের কাব্যের ক্লাসিকতার জন্যই । চরিত্র চিত্রণ , ভাষা প্রয়োগ , ছন্দ - অলংকার ও জীনববোধে ঘনরাম ক্লাসিকতার পথ ধরে হেঁটেছেন । অষ্টাদশ শতকে যখন মধ্যযুগের বিদায়সুর জেগে উঠেছে তখনও তিনি নতুন সুর শুনিয়েছেন , এখানেই তিনি অন্যতম কবি ও মধ্যযুগের কাব্যসারণিতে উল্লেখযোগ্য স্থানের অধিকারী ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ