৩)' দিকদর্শন ' থেকে 'বঙ্গদর্শন' পর্যন্ত বাংলা সাময়িক পত্রিকার গুরুত্ব উল্লেখ করো।
উত্তর:- বঙ্গদর্শন ' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।
✉বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘ বঙ্গদর্শন ' পত্রিকা ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয় ।
✉💠বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ বঙ্গদর্শন ' । উনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই । এজন্যেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— “ পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম । কোথায় গেল সেই অন্ধকার , সেই একাকার , সেই সুপ্তি — কোথায় গেল সেই ' বিজয়বসন্ত ' , সেই ‘ গোলেবকাওলি ' , সেই বালকভুলানো ছড়া — কোথা হইতে আসিল এত আলোক , এত আশা , এত সংগীত , এত বৈচিত্র্য । কত কাব্য - নাটক - উপন্যাস , কত প্রবন্ধ , কত সমালোচনা , কত মাসিকপত্র , কত সংবাদপত্র , বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাত কলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল । বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল । ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব আগেই হয়েছে , কিন্তু দেশ , সমাজজীবন , বঙ্গদেশ সম্পর্কে তাঁর অনেক কিছু বলার আছে , এজন্যই প্রকাশ করেছিলেন ‘ বঙ্গদর্শন ' । দেশ , জাতিকে দেখার এক আত্মদর্শন । ‘ বিষবৃক্ষ ’ , ‘ কৃষ্ণকান্তের উইল ’ , ‘ রজনী ’ সহ একাধিক উপন্যাস ও প্রবন্ধ নিয়ে তিনি বাঙালি পাঠকের জন্য হাজির হলেন । ‘ বঙ্গদেশের কৃষক , ‘ সাম্য ’ লিখে বঙ্কিম বাঙালিকে জাতীয়তাবোধে উদ্দীপিত করলেন । এই বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই বঙ্কিম প্রথম তুলনামূলক সমালোচনার সূত্রপাত করলেন । বাংলাভাষাকে এক উচ্চ মহিমায় নিয়ে গেলেন । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে যে অর্থে বঙ্কিমযুগ বলা হয় তার সূত্রপাত হয়েছিল ' বঙ্গদর্শন ' পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই । বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন— “ বঙ্কিমবাবুর বঙ্গদর্শনের গুণে বাঙালী বাবু সখ করিয়া বাঙ্গালা পড়িতে শিক্ষা করেন । KURSER P ‘ বঙ্গদর্শন ' - এ বঙ্কিম শুধু নিজেই লেখক ছিলেন না একদল লেখক গোষ্ঠী তৈরি করে নিয়েছিলেন । উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে যাঁদের অবদান অনেকখানি । ‘ বঙ্গদর্শন ’ - এর লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে আছে রামদাস সেন , হরপ্রসাদ শাস্ত্রী , চন্দ্রনাথ বসু , রাজকৃষু মুখোপাধ্যায় , অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ । বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে এ পত্রিকার অবদান ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে যে গদ্যের বিকাশ শুরু হয়েছিল তা বঙ্কিম ও বঙ্গদর্শনের হাতে এসে পূর্ণতা পেল । এই ‘ বঙ্গদর্শন ই যৌবনে মুগ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথকে । এজন্যই ‘ বঙ্গদর্শন ' বন্ধ হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথ নতুন করে শুরু করেছিলেন ‘ নবপর্যায় বঙ্গদর্শন ' পত্রিকা ।
৪)বাংলা কাব্যে কবি ঈশ্বর গুপ্তের অবদান আলোচনা করো ?
উত্তর:- কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলার কাব্যজগতে ‘ যুগসন্ধির কবি ’ হিসেবে । কবিওয়ালাদের উত্তরাধিকারী ঈশ্বর গুপ্ত সাংবাদিক সুলভ মন নিয়ে বাংলা কাব্যজগতে প্রবেশ করলেও আধুনিকতার সূত্রপাত করে গিয়েছিলেন । ' সংবাদ প্রভাকর ' পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন । তবে সমস্ত পরিচয়কে অতিক্রম করে বড়ো হয়ে উঠেছে কবি ঈশ্বর গুপ্তর পরিচয় । বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন— “ ঈশ্বরচন্দ্রের এই মহৎ গুণ ছিল যে , তিনি খাঁটি জিনিষ বড় ভালবাসিতেন , মেকির বড় শত্রু । ” বিচিত্র বিষয় নিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত কবিতা লিখেছেন । স্বদেশ , সমাজ , ইংরেজ সরকারের অত্যাচার সমস্ত বিষয় নিয়ে তিনি কবিতার সৃষ্টিভুবন ভরিয়ে তুলেছেন । সমাজের নানা অধঃপতিত অবস্থা তিনি তুলে ধরেছেন । আবার কখনও যুক্তির আশ্রয় নিয়ে বাঙালির ধর্মবিশ্বাসে আঘাত এনেছেন । ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাস হেনে তিনি বাঙালি পাঠককে শোনান
“ তোমার বদনে যদি , না সরে বচন ।
কেমনে হইবে তবে , কথোপকথন ।।
আমি যদি কিছু বলি , বুঝে অভিপ্রায় ।
ইসেরায় ঘাড় নেড়ে , সায় দিও তায় ।। ”
ঈশ্বর গুপ্ত ইতিহাস সচেতন , স্বদেশবর্তী হলেও নারীদের সম্পর্কে তেমন স্বাধীনচেতা ছিলেন না । কেননা বিমাতা শাসিত সংসারে বড়ো হওয়ার ফলে নারী সম্পর্কে তাঁর মনে বিরূপ ধারণার জন্ম হয়েছিল । তাই নারীদের ব্যঙ্গ করে লিখেছেন—
“ লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল
তারাই এখন চড়বে ঘোড়া
ঠাটঠমকে চালাক চতুর
সভ্য হবে খোড়া খোড়া ! ”
মিশনারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি যেমন প্রতিবাদী কণ্ঠে গর্জে উঠেছেন তেমনি সমাজকে , দেশকে নবযুগের চেতনায় দীক্ষিত করতে চেয়েছেন । বিচিত্র বিষয় নিয়ে তিনি কাব্যে নেমেছিলেন । সেই বিচিত্র বিষয়ে ব্যঙ্গের সঙ্গে হাস্যরসও ফুটে উঠেছে । তাই তপসে মাছ থেকে আনারস ও পাঁঠাকেও তিনি কবিতার বিষয় করে তুলতে পারেন পাঁঠা নিয়ে তিনি সরস হাস্যরসে লিখে বসেন—
“ রসভরা রসময় রসের ছাগল
তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল
তুমি যার পেটে যাও সেই পুণ্যবান
তুমি সাধু সাধু তুমি ছাগীর সন্তান । ”
এ সমস্ত গুণ অতিক্রম করে বড়ো হয়ে উঠেছে ঈশ্বর গুপ্তের স্বদেশচেতনা , যা উনিশ শতকে নবজাগরণের কালে বিশেষ প্রয়োজন ছিল । আসলে ঈশ্বর গুপ্তই প্রথম আধুনিক কবি যিনি বাঙালিকে জাগাতে চেয়েছিলেন । সেই সঙ্গে ছিল বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা । তাই তিনি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন—
“ জননী ভারতভূমি আর কেন থাক তুমি
ধর্মরূপ ভূষাহীন হয়ে ।
তোমার কুমার যত সকলেই জ্ঞানহত
মিছে কেন মর ভার বয়ে ? ”
ঈশ্বর গুপ্তের বড়ো কৃতিত্ব কবিগোষ্ঠী তৈরি করা । ঈশ্বর গুপ্ত আধুনিকতার বাণী নিয়ে কাব্য পরিক্রমায় অবতীর্ণ হলেও তিনি ছিলেন নীতিবাদে বিশ্বাসী । আসলে তিনি ছিলেন কবিওয়ালাদের উত্তরাধিকারী , ফলে সম্পূর্ণ নবীন চেতনায় বিশ্বাস রাখতে পারেননি । ঈশ্বর গুপ্ত যেন এক কালে দাঁড়িয়ে দুই যুগকে এক তারে বেঁধে রেখেছেন । এজন্যই তিনি যুগসন্ধির কবি।

0 মন্তব্যসমূহ
Thank you