প্রশ্ন :- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কাকে বলে? শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার জনক কে, এবং শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো!
ভূমিকা:- আধুনিক শিক্ষার প্রধানতম মানদন্ড হল শিশু, শিশুকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশকে তরান্বিত করতে গিয়ে শিশুর আগ্রহ, রুচি ও প্রবণতাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার পরিচালনার ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ বাইরে থেকে কোন কিছু জোড় করে শিক্ষার্থীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তার নিজের চাহিদা এবং যে সমাজে সে বাস করে সেই সমাজের চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে শিক্ষা গড়ে তুলতে হবে।
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা :- আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো শিশু। শিশুই আধুনিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। আধুনিক শিক্ষাকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলা হয়।
যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর আগ্রহ, চাহিদা, রুচি, দক্ষতা, ক্ষমতা, মনোভাব, ইচ্ছা, প্রক্ষোভ ইত্যাদির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় তাকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলে।
👉 আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার জনক হলেন - রুশো।
আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যাবলী:
প্রাচীন ধারণা আনুযায়ী শিক্ষা ছিল জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া মাত্র। শিক্ষক জ্ঞানের ভাণ্ডার তিনি তার উর্ধিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করতেন। শিক্ষার্থীদের কাজ ছিল সেই জ্ঞান আহরণ করা কিন্তু শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর ধারণাকে অনেক বেশি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া চলেছে তাই হল শিক্ষা। ফলে শিশুর কাছে শিক্ষা হল একধরণের অভিযোজনের প্রক্রিয়া। শিক্ষার এই তাৎপর্য শিশুকেন্দ্রিকতার ধারণার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা দান করেছে। আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হল-। যেমন-
১) আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ধারণা: প্রাচীন ধারণানুযায়ী শিক্ষা ছিল জ্ঞান আহরণের কৌশলমাত্র। কিন্তু আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার শিক্ষা শব্দকে অনেক বেশি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষা হল শিশুর জীবনে এক ধরণের অভিযোজন প্রক্রিয়া। শিক্ষার এই তাৎপর্য শিশুর জীবনভিত্তিক এবং শিশুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
২) শিক্ষার লক্ষ্যঃ আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তির কল্যাণের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ সাধন করা। এই প্রসঙ্গে জন ডিউই বলেছেন— “ শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বাড়িয়ে তুলে তার সামাজিক যোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলা।"
৩) শিক্ষার পাঠক্রম: প্রাচীন ধারণানুযায়ী সার্থক শিক্ষার পাঠক্রমের মধ্যে থাকবে সমাজের অতীত অভিজ্ঞতা। কিন্তু শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠক্রমের নতুন গতিধর্মী সংব্যাখ্যান দেওয়া হয়েছে। এই পাঠক্রম হবে পরিবর্তনশীল এবং জীবনভিত্তিক। শিশুর এবং সমাজের চাহিদা উভয়কে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই পাঠক্রমে।
৪) শিক্ষার পদ্ধতি: আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষণ পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানসম্মত। শিশুর আগ্রহ, ক্ষমতা ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন— ডাল্টন পরিকল্পনা, প্রোজেক্ট পদ্ধতি, বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা, উইনেটকা পরিকল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
৫) শিক্ষায় শিক্ষকের কাজ : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষকের কাজ ও দায়িত্বের পরিবর্তন ও বিস্তৃতি ঘটেছে। তার দায়িত্ব হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশে সাহায্য করা। শিক্ষক মহাশয় তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব, নিজের কুশলতা ও সমবেদনামূলক মনোভাবের এবং জীবন দর্শনের শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করবেন। তিনি হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু, নির্দেশক এবং জীবন দর্শনের প্ৰতীক ।
৬) শিক্ষায় বিদ্যালয়: শিশুকেন্দ্ৰিক শিক্ষায় শিক্ষালয়ের বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষালয় হবে সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। এখানে শিক্ষালয়কে সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে সংগঠিত করার কথা বলা হয়েছে।
৭) শিক্ষায় খৃঙ্খলা: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় মুক্ত শৃঙ্খলা বা স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচীন ধারণানুযায়ী শিশুর স্বতঃস্ফুর্তইচ্ছাকে দমন করার পরিবর্তে স্বাভাবিক ও স্বাধীনতা দান করা হয়েছে।
৮) শিক্ষা ও সক্রিয়তা : আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর সক্রিয়তার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী হাতে কলমে কাজ করে নিজে যা শিখবে, তাই হবে তার প্রকৃত শিক্ষা।
৯) শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা : এখানে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে শিক্ষা দেওয়ার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাকে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষাও বলা যায়।
১০) শিক্ষা ও সৃজনশীলতা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সৃজনী স্পৃহাকে চরিতার্থ করার চেষ্টা করা হয় এবং বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তার সৃজনাত্মক ক্ষমতার উন্মেষ সাধন করা হয়।
১১) শিক্ষা ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী: খেলাধূলা, সাহিত্যচর্চা, ভ্রমণ ইত্যাদির মত কাজগুলি এই নতুন তাৎপর্যে সহপাঠ্যক্রমিক নামে সংযোজিত হয়েছে।
১২) শিক্ষা ও স্বাধীনতা: সবশেষে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিক্ষার্থীকে শিক্ষাক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতাদানের নীতি ঘোষণা করেছে। তার এই স্বাধীনতার অর্থ উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে শিশুরা যাতে নিজেরাই নিজেদের শৃঙ্খলিত করতে পারে তার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় এই শিক্ষা ব্যবস্থায়।
মন্তব্য: সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিশুর পরিপূর্ণ জীবনবিকাশে এবং সমাজের গতানুগতিকতাকে বর্জন করে কল্যাণকারী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার তাৎপর্য বা প্রয়োজনীয়তা
ক) শিক্ষাই জীবন (Education isজীবন)
i) জীবনের ন্যায় প্রক্রিয়া
ii) প্রয়োজনীয় উপাদান
iii) শিশুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি
খ) শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ
i) চাহিদার প্রতি গুরুত্ব
ii) ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে গুরুত্ব
iii) অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলির বিকাশ
গ) শিশু কেন্দ্রিকতার নীতিসমূহ
i)পাঠক্রম নির্ধারণ
ii) শিশুকে ভিত্তি করে পাঠক্রম
ঘ) শিখন পদ্ধতি
i) সক্রিয়তার উপর গুরুত্ব
ii) আদর্শ পদ্ধতি
iii) বিজ্ঞানভিত্তিক
ঙ) পরিচালনা
i) গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন
ii) আত্মশৃঙ্খলায় গুরুত্ব আরোপ
iii) গণতান্ত্রিকতার নীতি প্রয়োগ


0 মন্তব্যসমূহ
Thank you