ভূমিকা (Introduction):- দেহ ও মন নিয়ে সম্পূর্ণ মানুষ। মানুষের দৈহিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক বিকাশ ঘটে। এই মানসিক বিকাশ ও তার আচার-আচরণকে কেন্দ্র করে যে বিষয়ের উদ্ভব তাই হল মনোবিদ্যা (Psychology)। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল তাঁর De Anima গ্রন্থে মনোবিদ্যাকে পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেন। অতীতে মনোবিদ্যা দর্শনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু আধুনিককালে মনোবিদ্যা একটি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করায় এটি পৃথিবীর একটি নবীনতম বিষয়।
মনোবিদ্যা
:- প্লেটো প্রমুখের মতে, মনোবিদ্যা
হল আত্মার বিজ্ঞান (Psychology is the science of soul)| কিন্তু পরবর্তীকালে মনোবিদদের
কাছে মনোবিদ্যার এই ধারণাটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ তাঁদের মতে, আত্মা (soul) যেহেতু
পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের বিষয়বস্তু নয়, সেহেতু আত্মা কোনো বিজ্ঞানের বিষয় হতে পারে না।
তাই মনোবিদ্যাকে কখনোই আত্মার বিজ্ঞান বলা যায় না।
শিক্ষা মনোবিদ্যা :- মনোবিদ ক্রো এবং
ক্রো-এর মতে, "Educational Psychology describes and explains the
learning experiences of an individual from birth through old age." অর্থাৎ,
শিক্ষা মনোবিদ্যা ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিখন অভিজ্ঞতার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা
করে।
❏ বি.এফ.স্কিনারের মতে, শিক্ষা মনোবিদ্যা হল মনোবিদ্যার সেই
শাখা যা শিক্ষণ ও শিখন সম্পর্কীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
শিক্ষা
ও শিক্ষা মনোবিদ্যা সম্পর্ক :- শিক্ষাবিজ্ঞানকে মনোবিদ্যা বিভিন্ন দিক থেকে প্রভাবিত
করে থাকে। শিক্ষাবিজ্ঞানের দুটি দিক রয়েছে। যথা- তাত্ত্বিক দিক (Theoretical
Aspect), ব্যাবহারিক দিক (Practical Aspect)। শিক্ষাবিজ্ঞানের বিশেষ দুটি দিকের সঙ্গে
মনোবিদ্যা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকের ওপর মনোবিদ্যার
প্রভাব :- শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকের ওপর মনোবিদ্যার
প্রভাব (Influence of Psychology on the theoretical aspects of education) লক্ষ করা
যায় তা নিম্নে আলোচনা করা হল-
1. শিক্ষার উদ্দেশ্য:- আধুনিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির মনের পরিপূর্ণ
বিকাশসাধন। মনোবিদ্যার উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির আচরণ অনুশীলন করা। ব্যক্তির চাহিদা, সামর্থ্য,
প্রবণতা ইত্যাদি অনুযায়ী শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্ধারণে সাহায্য করা।
2. শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ:- শিক্ষার উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে বিষয়বস্তু নির্ধারিত
হয়ে থাকে। শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণে মনোবিদ্যা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
3. শিশুকেন্দ্রিকতা:- আধুনিক শিক্ষার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শিশুকেন্দ্রিকতা।
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার অর্থ হল মনোবিদ্যা নির্ভর শিক্ষা। শিশুর মানসিক দিকগুলি বিচারবিশ্লেষণ
করে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে সাহায্য করে মনোবিদ্যা।
3. শিক্ষা পদ্ধতি:- শিশুর শিক্ষা পদ্ধতি নির্ধারণে মনোবিদ্যার জ্ঞানের
প্রয়োজন। শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য শিক্ষা পদ্ধতিকে আকর্ষণীয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ
ও আগ্রহভিত্তিক করে তুলতে মনোবিদ্যা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে।
শিক্ষার ব্যাবহারিক দিকের ওপর মনোবিদ্যার
প্রভাব :- শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকের পাশাপাশি তার
ব্যাবহারিক দিককেও মনোবিদ্যা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। তা হল-
1. পাঠ পরিকল্পনা:- শিক্ষার্থীর পাঠ পরিকল্পনায় মনোবিদ্যা
বিশেষ ভাবে সাহায্য করে। যেমন-হার্বার্ট স্পেনসার পাঠ পরিকল্পনার জন্য যে নীতি অনুসরণ
করেছিলেন, আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে তার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। তাঁর মতে, শিশু স্বাভাবিক
প্রক্রিয়ার নীতি অনুসরণ করে শিক্ষালাভ করে থাকে।
2. পাঠ্যপুস্তক রচনা:- শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যপুস্তক
রচনা এবং নির্বাচন করা হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে মনোবিদ্যার যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
3. সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলি:- শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমিক শিক্ষা-
দানের পাশাপাশি সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলির শিক্ষাদান করা হয়। সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলি
হল বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক, যা শিক্ষার্থীর একঘেয়েমি দূর করে, শিক্ষায় আগ্রহ
বৃদ্ধি করে। এই ক্ষেত্রে মনোবিদ্যা সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলি নির্বাচনে বিশেষভাবে সাহায্য
করে।
4. সময়তালিকা নির্ধারণ:- বিদ্যালয়ের সময়তালিকা
নির্ধারণে কোন্ কোন্ নীতি অনুসরণ করা উচিত সেই বিষয়ে মনোবিদ্যা শিক্ষাবিজ্ঞানকে সাহায্য
করে। তাই এই দিক বিচারে শিক্ষা-বিজ্ঞানের সঙ্গে মনোবিদ্যা গভীর সম্পর্কযুক্ত।
5. শিক্ষার উপকরণের ব্যবহার: শিক্ষার্থীর শিখনকে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং আকর্ষণীয়
করে তুলতে সাহায্য করে শিক্ষার উপকরণ। এই শিক্ষার উপকরণগুলির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে
জ্ঞানদান করে মনোবিদ্যা।
উপসংহার:-
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, মনোবিদ্যা ও শিক্ষার সম্পর্ক শিশুর শিখনকে যেমন সহজ-সরল,
বৈচিত্র্যপূর্ণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর করে তুলেছে তেমনি শিক্ষণ ব্যবস্থাকে আরও
উন্নত করেছে, যার প্রভাব আমরা আধুনিক শিক্ষা মনোবিদ্যায় দেখতে পাই।
বৃদ্ধি ও বিকাশ বলতে কি বোঝ ? বিকাশের নীতিগুলি আলোচনা কর ?
ভূমিকা (Introduction):- মানবজীবনের
শুরু মাতৃজঠরে। ওই জঠরেই শুরু হয় বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রক্রিয়া। বৃদ্ধি হল জীবের-ধর্ম,
এটিই হল একপ্রকারের জৈবিক পরিণমন।বৃদ্ধি হল মন্থর, নিরবচ্ছিন্ন, ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া।
ওই অন্থর ও নিরবচ্ছিন্ন ধারা এক সময়ে এসে থেমে যায় অর্থাৎ, বৃদ্ধির পরিসমাপ্তি ঘটে।
বৃদ্ধির ফলে ঘট শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন। বৃদ্ধির পরিবর্তন প্রাণীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের
দ্বারা চালিত হয়।পরিমাণগত পরিবর্তন ব্যাতিরেকে আর-এক ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়,
তা হল গুণগত পরিবর্তন।বিকাশ মাতৃজঠরে শুরু হয়ে সারাটা জীবন ধরে চলার পর মৃত্যুতে গিয়ে
শেষ হয় অর্থাৎ, বিকাশ জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।
বৃদ্ধি
:- বৃদ্ধি হল আকার-আয়তন
মাত্রিক এমন এক জৈনিক ✓ পরিণমন
যা মাতৃজঠর থেকে শুরু হয়ে উন্নয়নমুখী নিরবচ্ছিন্ন ধারায় এক স্তরে এসে থেমে যায়।
বিকাশ:-
বিকাশ হল এমন এক ক্রমোন্নয়নশীল
গুণগত পরিবর্তনের জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া যা মাতৃজঠর থেকে শুরু হয়ে মৃত্যুতে গিয়ে শেষ
হয় ।
বিকাশের নীতি:- শিক্ষা ক্ষেত্রে বিকাশের যে
নীতি গুলি রয়েছে সে নীতি গুলিকে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১.অবিচ্ছিন্নতার নীতি:- বিকাশ অবিচ্ছিন্ন বা নিরবচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে চলে।
মাতৃগর্ভে ভ্রুণ সঞ্চারের শুরু থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিকাশ ঘটে থাকে। অর্থাৎ, বিকাশ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে ঘটে থাকে। বিভিন্ন
২.ব্যক্তিবৈষম্যের নীতি: ব্যক্তিভেদে বিকাশের মধ্যে পার্থক্য
দেখা যায়। এমনকি যমজ শিশুর ক্ষেত্রেও দেখা যায় মানবজীবন বিকাশের সকল স্তরে সকল ব্যক্তির
বিকাশের হার একই রকম হয় না। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, নৈতিক
ইত্যাদি বিকাশের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়।
3. ক্রম সমষ্টিমূলক: - ব্যক্তির দৈহিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে
তার বৌদ্ধিক, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক বিকাশ ঘটে থাকে অর্থাৎ, একটি বিকাশের সঙ্গে সংগতি
রেখে অন্য বৈশিষ্ট্যগুলির বিকাশ ঘটে। তাই বিকাশের প্রক্রিয়া হল ক্রম সমষ্টিমূলক।
4. সাধারণ থেকে বিশেষের নীতি:- বিকাশের একটি অন্যতম নীতি হল সাধারণ থেকে বিশেষের
নীতি। শিশুর বিকাশ প্রথমে সামগ্রিকভাবে ঘটে ধীরে ধীরে তা বিশেষের দিকে এগিয়ে চলে। অর্থাৎ,
শিশুর সামগ্রিক আচরণের ধীরে ধীরে পৃথকীকরণ ঘটে।
5. বংশগতি ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার নীতিঃ- মানবজীবন বিকাশ শিশুর বংশগতি ও পরিবেশের
মিথস্ক্রিয়ার ফলে সংগঠিত হয়ে থাকে। শিশু জন্মগতভাবে যেমন কিছু ক্ষমতা পেয়ে থাকে তেমনি
পরিবেশ সেই ক্ষমতা ও সম্ভাবনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই বলা হয় বিকাশ
হল বংশগতি ও পরিবেশের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফল।
6. অগ্রমুখীতার নীতি:- বিকাশ অগ্রমুখীতার নীতি অনুসরণ করে
এগিয়ে চলে। কারণ বিকাশ একটি ধারাবাহিক, অবিচ্ছিন্ন, গতিশীল প্রক্রিয়া। মাতৃগর্ভে ভূণ
সঞ্চারের পর থেকে এই প্রক্রিয়া মৃত্যুর আগে পর্যন্ত চলতে থাকে।
7. সর্পিল বনাম রৈখিক গতির নীতি: বিকাশ সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলে। শিশুর
যে-কোনো স্তরের বিকাশ একটি নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যাওয়ার পর সর্পিল ভঙ্গিতে আবার পিছনে
ফিরে তারপর আবার সামনের দিকে এগিয়ে চলে। তাই বিকাশের যে-কোনো স্তরে তার পূর্ববর্তী
স্তরের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
8. ঐক্যের নীতি:- মানবজীবনের বিকাশ ঐক্যের নীতি অনুসরণ করে এগিয়ে চলে।
এক ধরনের বিকাশ অন্য আর এক ধরনের বিকাশকে (দৈহিক, মানসিক, সামাজিক) স্বাভাবিক করে,
ফলে ঐক্য বজায় থাকে।
9. পরিবর্তনশীলতার নীতি:- বিকাশ হল একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া।
কারণ, যে-কোনো পর্যায়ে ব্যক্তির অবস্থা, তার পূর্ববর্তী সকল পর্যায়ের বিকাশের সমষ্টিগত
ফল। বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক প্রভৃতি সকল দিকের
পরিবর্তন ঘটে।
10.বহুবিধ উপাদানের প্রভাবের নীতি:- মানবজীবন বিকাশের প্রক্রিয়া অত্যন্ত
জটিল, যা বহুবিধ উপাদানের প্রভাবের দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে। যেমন-স্বাস্থ্য, পুষ্টি, গ্রন্থিসমূহের
এ অভ্যন্তরীণ ক্ষরণ, বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব ইত্যাদি ।


0 মন্তব্যসমূহ
Thank you