রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটক আলোচনা।
বিসর্জন নাটক – দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিসর্জন’ নাটক একটি কাব্যনাট্য। রবীন্দ্রনাথ শেক্সপীয়রীয় পঞ্চাঙ্ক রীতিতে ১৮৯০খ্রি: ‘বিসর্জন’ কাব্যনাট্যটি রচনা করেছিলেন। নাটকটিকে রবীন্দ্রনাথ দুটি ভিন্ন সময়ে মঞ্চস্থ করেছিলেন দুটি পৃথক চরিত্রে অভিনয় করে। ১৮৯০ সালে যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
‘বিসর্জন’ নাটকটি জীবপ্রেম ও মানবপ্রেমের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিপরীতে মানবপ্রেমই সংকট থেকে উত্তরণের উপায়, শান্তির নিয়ামক – এই ভাবনা রবীন্দ্রসাহিত্যের নানাক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে।
‘বিদেশী অতিথি ও দেশী আতিথ্য’ এবং ‘অনধিকার প্রবেশ’ গল্প – প্রায় সমসাময়িককালে প্রকাশিত এই রচনাদুটিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ভাবনার ফসল। আর ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মবিষয়ক এই ভাবনা প্রকাশিত, সেই ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের অংশ বিশেষ নিয়েই রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটকটি।
‘বিসর্জন’ নাটকের রবীন্দ্রনাথ মূলত মনুষ্যত্ব ও পশুত্বের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মানবপ্রেমের বাহক মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মাদর্শের মূল মানবপ্রেম। রবীন্দ্রভাবনার প্রতিনিধি গোবিন্দমাণিক্য ‘বিসর্জন’ নাটকে তার কথাই আগাগোড়া বলে গেছে। নাটকের শুরুতে রাজমহিষী গুণবতী সন্তানলাভের আশায় রঘুপতির কাছে পশুবলির ইচ্ছা প্রকাশ করে দেবীর সন্তোষ প্রার্থনা করছে। অপরদিকে রাজা গোবিন্দমাণিক্য পূজোর নামে পশুবলি তথা জীবহত্যা করার মতো নির্মম প্রথাকে তার রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। ফলে ধর্মীয় গোঁড়া সংস্কারে বিশ্বাসী রাজপুরোহিত রঘুপতির বিরাগভাজন হয়ে পড়েছেন গোবিন্দমাণিক্য। রঘুপতি তাঁর ব্রাহ্মণ্যের অহং ধর্ম এবং ধর্মের প্রতিপত্তির আস্ফালনে সগর্বে ঘোষণা করেন ‘শাস্ত্রবিধি তোমার বিধান নহে’। ফলে ‘বিসর্জন’ নাটকের দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায় রাজশক্তি ও ধর্মশক্তিকে কেন্দ্র করে।এ লড়াইয়ে দ্বিধাভক্ত হয়ে যায় সমগ্র রাজ্য, রাণী রাজপরিষদ সহ সকলেই চলে যান রাজার বিরুদ্ধে। আসলে যে কোনো কুপ্রথাই অনেকদিন ধরে চলতে থাকলে তা ভাবনাবিহীন সাধারণ মানুষের কাছে সংস্কারে পরিণত হয়। সতীদাহ প্রথা, বৈধব্য সংস্কার, পশুবলি, ধর্মীয় সংস্কারের নামে এরকম অনেক কুপ্রথা আজও সমাজে প্রচলিত। কিন্তু নি:সঙ্গ রাজার মর্মকথা উপলব্ধি করতে পারে রঘুপতির প্রাণাধিক প্রিয় পালিত পুত্র জয়সিংহ এবং আর তার সঙ্গিনী অপর্ণা।
আধিপত্যের মোহে রঘুপতি গোবিন্দমাণিক্যের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, ভাইকে দিয়ে ভ্রাতৃহত্যার ষড়যন্ত্র এবং রাজ্যের মঙ্গলে দেবীর স্বপ্নাদেশ রাজরক্ত চাওয়া – এসব দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে জয়সিংহ। অবশেষে রাজরক্ত আসে জয়সিংহের আত্মোৎসর্গে, প্রিয় মানুষকে হারিয়ে রঘুপতির চেতনার উদয় হয়।
“পাষাণ ভাঙিয়া গেল – জননী আমার
এবার দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা
জননী অমৃতময়ী।”
– রঘুপতির এই আত্মবোধনে জয়লাভ করে প্রেম, এখানেই রবীন্দ্রনাথের ধর্মাদর্শ ব্যাপকতা লাভ করে, মানবপ্রেম থেকে পৌঁছে যায় জীবপ্রেমে; জীবনের প্রতি প্রবল অনুরাগই মূল যার আশ্রয় কখনোও রাজধর্ম, কখনো দেবধর্ম, কখনো মানবধর্ম। ধর্ম কেবল নিছক আচারসর্বস্বতা নয়, ধর্ম হল যা ধারণ করে, জীবপ্রেমই তাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম সংক্রান্ত ভাবনার প্রকাশ মূলত ঘটেছে ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধগুলিতে। ব্রাহ্মধর্ম বিশ্বাসী পিতার সাহচর্য, পরিবারের উদার মানসিকতা, উপনিষদ – এসবই রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তাকে প্রসারিত করেছে। তাঁর মতে মানুষের দেবতা আসলে মানুষের মনে অবস্থিত, অন্তরস্থিত বিবেকই মানুষকে সত্যের প্রতি প্রণোদিত করে। ‘মানবসত্য’ প্রবন্ধে বলেছেন – “জীবনদেবতার সঙ্গে জীবনকে পৃথক করে দেখলেই দুঃখ, মিলিয়ে দেখলেই মুক্তি”। বিশ্বপ্রকৃতি ও বিশ্বমানবের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল সংস্কারমুক্ত এবং ভেদাভেদশূন্য। ‘কাহিনী’ কাব্যের ‘সতী’ কবিতায় আছে –
“বৃথা আচার বিচার। সমাজের চেয়ে
হৃদয়ের নিত্য ধর্ম সত্য চিরদিন।”
‘বাল্মীকি প্রতিভা’র মধ্যে হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে তাই পূর্ণতা পেয়েছে ‘বিসর্জন’ নাটকে এই ঘোষণায় – “দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ”। রবীন্দ্রনাথ বলছেন – “এই নাটকে বরাবর দুটি ভাবের মধ্যে বিরোধ বেধেছে – প্রেম এবং প্রতাপ। প্রভাতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে জানিয়েছেন যে, গোবিন্দমাণিক্যকে জয়যুক্ত করলেও বিপরীত শক্তিকে খর্ব করেননি – এতেই ‘বিসর্জন’ নাটকে আবেগময় ভাব প্রকাশ পেয়েছে। তবে, ড: নীহাররঞ্জন রায় ‘রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা‘ গ্রন্থে ‘বিসর্জন’ নাটকের আলোচনার প্রসঙ্গে বলেছেন – গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্র মহৎ , কিন্তু বিকাশের দিক থেকে তা সুন্দর নয়। কোনো দ্বিধা নাই, দ্বন্দ্ব নাই, সংশয় নাই, প্রতিমুহূর্তের অনুভবের নূতনত্বের মধ্যে যে রসের লীলা, মনের মধ্যে যে সংশয়ের দোলা, গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্রে তা নেই। এছাড়া অপর্ণা চরিত্র সম্পর্কে বলছেন – অপর্ণা একটা আইডিয়ার রসমূর্তি, কোনও জীবনের বিকাশ নয়, রক্তমাংসের একটি মানবকন্যার রূপ তাহার মধ্যে কোথাও ফুটিয়া উঠে নাই। আবার ড. অজিত ঘোষ নাটকে কতগুলি অসঙ্গতি দেখিয়ে বলেছেন – প্রভুভক্ত চাঁদপাল কীভাবে বিদ্রোহী হয়ে পড়ল তা নাটকে উল্লেখ নেই। একইভাবে ধ্রুবহত্যার ষড়যন্ত্রও নাটকে অস্ফুট থেকে গেছে।
তা সত্ত্বেও জয়সিংহের বিসর্জনে রঘুপতির যে পরাজয় এবং পরিবর্তন – এই ‘বিসর্জন’ নাটকের তত্ত্বকে সার্থক করেছে। আর ধর্ম যখন প্রকৃত স্বরূপ হারিয়ে নিমজ্জিত হয় গোড়ামি ও আচার সর্বস্বতায় তখন তা হয়ে ওঠে মানবতাবিরোধী – এই মর্মে দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ – এই বাণী শাশ্বত।
১) বিসর্জন নাটকের ভিকারীর বালিকার নাম কী?
> অপর্ণা ।

7 মন্তব্যসমূহ
Nice
উত্তরমুছুনamra aro chai eirakom bisaybostur alochona
উত্তরমুছুনNice
উত্তরমুছুনKhun Bhalo sir
উত্তরমুছুনBhalo legeche
উত্তরমুছুনভালো
উত্তরমুছুনখুব ভালো
উত্তরমুছুনThank you